বহুল প্রতীক্ষিত কাতার বিশ্বকাপের সঙ্গে সময়ের দূরত্ব মাত্র একদিনের। আগামীকাল রাতে দোহায় পর্দা উঠবে জমকালো এ আয়োজনের। কার্যত গোটা দুনিয়া কাঁপছে বিশ্বকাপ জ্বরে। নিঃশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা ফুটবল মহাযজ্ঞে খেলবেন লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো,নেইমার জুনিয়র, হ্যারি কেনের মতো ফুটবলাররা।





বিশ্বজুড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে এই রোমাঞ্চ। যা কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে গেছে বেশ কয়েকজন তারকা ফুটবলারের অনুপস্থিতিতে। যাদের কেউ পড়েছেন ইনজুরিতে, কারোর দল উতরাতে পারেনি বাছাইপর্বে কিংবা দল বিশ্বকাপে খেললেও ডাক পড়েনি তাদের। দেখে নেওয়া যাক সেসব তারকা ফুটবলার দর্শককে।





আর্লিং হাল্যান্ড (নরওয়ে): ‘ছোট’ দেশের ‘বড়’ তারকা আর্লিং হাল্যান্ড। ক্লাব ফুটবলের ‘বিস্ময় বালক’ তিনি। এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটিতে স্বপ্নের ফর্মে আছেন। কিন্তু ক্লাবের মতো জাতীয় দলে অমন অতিমানবীয় পারফর্ম করতে পারেননি তিনি। তার দল নরওয়েও বাদ পড়েছে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে। সেই দুঃস্বপ্ন ভুলে আগামী ইউরো ও বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখছেন সিটি স্ট্রাইকার। নরওয়ের আরেক তারকা মার্টিন ওডেগার্ডকেও মিস করবে কাতার বিশ্বকাপ।





জিয়ানলুইজি ডোন্নারুম্মা (ইতালি): ক্লাব ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডোন্নারুম্মা। গোলপোস্টের নিচে তার বীরত্ব গত বছর ইতালির ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে রেখেছে বড় অবদান। অথচ এবারের বিশ্বকাপে দর্শক সারিতে থাকতে হবে পিএসজি তারকাকে। ডোন্নারুম্মার দল ইতালি বিশ্বকাপের মূলপর্বের টিকিট পায়নি। বাছাইপর্বের প্লে-অফ পর্বে অঘটনের শিকার হয়েছে আজ্জুরিরা। ২৩ বছর বয়সী ডোন্নারুম্মা আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৪৯টি ম্যাচ খেলেছেন। ইতালির নিকোলো বারেল্লা, জর্জিনহো, জর্জিও কিয়েলিনির মতো ফুটবলারকেও মিস করবে কাতার বিশ্বকাপ।





সাদিও মানে (সেনেগাল): প্রান্তসীমায় আসা বছরের শুরুতে দেশবাসীর স্বপ্নপূরণ করেছেন সাদিও মানে। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো আফ্রিকান নেশনস কাপ জিতেছে সেনেগাল। দেশকে বিশ্বকাপের মূলপর্বের টিকিট এনে দেওয়ারও অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। তাকে ঘিরেই কাতার বিশ্বকাপের সব পরিকল্পনা সাজানো ছিল দলটির। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েক দিন আগে ইনজুরি নিয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে যান বায়ার্ন মিউনিখ ফরওয়ার্ড। সেনেগাল আশাবাদী ছিল গ্রুপপর্বের পরের দুই ম্যাচে খেলতে পারবেন মানে। কিন্তু স্ক্যান রিপোর্টে আসে দুঃসংবাদ। বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় তার।





ডেভিড আলাবা (অস্ট্রিয়া): সব্যসাচী ফুটবলার বলা হয় ডেভিড আলাবাকে। ক্লাব ফুটবলে দলের হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপাই জিতেছেন তিনি। দুর্ভাগ্য এই ‘অলরাউন্ডার’ ফুটবলারের। কাতার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণ হয়নি তার। আলাবার দল অস্ট্রিয়া বাছাইপর্বেই ঝরে গেছে। ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বে অস্ট্রিয়ানরা চার দলের মধ্যে হয়েছে চতুর্থ। অগত্যা, কাতার বিশ্বকাপে অস্ট্রিয়া ও আলাবাকে থাকতে হচ্ছে দর্শক সারিতে।
মোহাম্মদ সালাহ (মিশর): ক্লাব ফুটবলের বড় তারকা। আফ্রিকান মহাদেশে এই মুহূর্তে যে দুজন বড় তারকা আছেন তাদের একজন মোহাম্মদ সালাহ। বছরের শিরোপা আফ্রিকান নেশনস কাপের ফাইনালে সালাহর দল মিশর হেরে যায় সাদিও মানের সেনেগালের কাছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে-অফও মুখোমুখি করে দিয়েছে তাদের। সেখানেও শেষ হাসি হাসে সেনেগাল। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার হতাশা ছুঁয়ে গেছে সালাহকে। কাতারের মহাযজ্ঞের বাইরে থাকা বড় মাপের তারকা ফুটবলার লিভারপুল ফরওয়ার্ড।
সার্জিও রামোস (স্পেন): গত বছর ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে পারেননি। কাতার বিশ্বকাপ দলেও সার্জিও রামোসের স্পেন দলে জায়গা না পাওয়াটা অনুমিতই ছিল। বয়স, ফর্মহীনতা এবং ইনজুরি মিলিয়ে রামোস তার স্পেন অধ্যায়ের শেষটা প্রায় দেখে ফেললেন। পিএসজি ডিফেন্ডারকে দেশের খেলা দেখতে হবে মাঠের বাইরে থেকে। সেই হতাশা অবশ্য লুকাননি তিনি। তবে পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়িয়ে, যে কোনো মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দিতে পারেন ইউরো-বিশ্ব-ইউরোজয়ী এই ডিফেন্ডার।
জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ (সুইডেন): গত বিশ্বকাপের ‘জায়ান্ট কিলার’ ভাবা হয়েছিল সুইডেনকে। ওই আসরে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচকে ছাড়াই খেলেছে সুইডিসরা। পরে অবসর ভেঙে জাতীয় দলে ফিরে আসেন ইব্রা। কিন্তু তাতে কাজের কাজ হয়নি। গত মার্চে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে-অফে রবার্ট লেভানডফস্কির পোল্যান্ডের কাছে হেরে যায় সুইডেন। অথচ বাছাইয়ে দুর্দান্ত খেলেছিল তারা। শেষ দিকে এসে তিন ম্যাচে পয়েন্ট খুইয়ে প্লে-অফে ছিটকে যায় ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্টরা। অবশ্য সুইডেন মূলপর্বের টিকিট পেলেও ইব্রার খেলা হতো না টুর্নামেন্টে। অস্ত্রোপচার পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি তার। ইব্রার মতো বিশ্বকাপ মিস করবে এমিল ফর্সবার্গের মতো তারকাকেও।
হ্যাভিয়ের হার্নান্দেজ চিচারিতো (মেক্সিকো): মেক্সিকান ফুটবলের বড় তারকা হ্যাভিয়ের হার্নান্দেজ চিচারিতো। অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিলেন তিনি। অথচ বিশ্বকাপ চূড়ান্ত দলে তাকে রাখেননি মেক্সিকোর আর্জেন্টিাইন কোচ জেরার্ডো টার্টা মার্টিনো। হার্নান্দেজের মতো অভিজ্ঞ আরেক ফরওয়ার্ড কার্লোস ভেলারও জায়গা হয়নি মেক্সিকান দলে। এই দুজনের একসঙ্গে বাদ পড়াটা অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে। তবে চোটে না পড়লে মেক্সিকো দলে থাকতে পারতেন জেসুস করোনা।
জিওভান্নি লো সোলসো (আর্জেন্টিনা): এবারের কাতার বিশ্বকাপে ফেভারিটের তালিকায় নাম আছে আর্জেন্টিনার। দলটি টানা ৩৬ ম্যাচ অজেয় আছে। দলের এই দুর্দান্ত যাত্রার অন্যতম সঙ্গী ছিলেন জিওভান্নি লো সোলসো। এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইনদের আক্রমণভাগের অন্যতম অংশ ছিলেন তিনি। অথচ টুর্নামেন্ট শুরুর কদিন আগে চোট নিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন ডিয়েগো সিমন-পুত্র। এরপর আরও দুটি ধাক্কা খেয়েছে আর্জেন্টিনা। শেষ সময়ে এসে ইনজুরিতে পড়েছেন নিকোলাস গঞ্জালেস ও হোয়াকুইন কোরেয়া। এই তিনজনকেই মিস করবে কাতার বিশ্বকাপ।
রবার্তো ফিরমিনো (ব্রাজিল): এবারের বিশ্বকাপের হট ফেভারিট পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। কাগজে-কলমে আসরে সম্ভাব্য সেরা দল সেলেকাওদের। ব্রাজিল কতটা শক্তিশালী এটা বোঝাতে একটা তথ্যই যথেষ্ট, ফর্মে থাকা লিভারপুল ফরওয়ার্ড রবার্তো ফিরমিনো পর্যন্ত ঠাঁই পাননি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দলে। দলটির আরেক তারকা ফিলিপ্পে কুতিনহো অবশ্য আগেই চোট নিয়ে ছিটকে গেছেন মাঠের বাইরে। তার বাদ পড়াটা অনুমিত হলেও ফিরমিনোর ব্রাজিল দলে ডাক না পাওয়াটা বড় চমকই বলা যায়।
লুইস দিয়াজ (কলম্বিয়া): হাঁটুর ইনজুরি নিয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে গেছেন লুইস দিয়াজ। অবশ্য চোটে না পড়লেও কাতার বিশ্বকাপে খেলা হতো না তার। কারণ দিয়াজের দল কলম্বিয়া বাদ পড়েছে বাছাইপর্বেই। প্লে-অফে মহাদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বী পেরুর কাছে হেরে গেছে তারা। খুব স্বাভাবিকভাবেই দিয়াজ মিস করছেন বিশ্বকাপ। ২০১৪ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুটজয়ী হ্যামেস রদ্রিগেজও এবারের আসরের তারকা দর্শক। দেশটির ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রাদামেল ফ্যালকাও-ও থাকছেন বিশ্বকাপের বাইরে।





পল পগবা (ফ্রান্স): সাড়ে চার বছর বছর আগে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের নায়কদের একজন ছিলেন পল পগবা। এবারের আসরে আরও পরিণত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে জুভেন্টাসের জন্য খেলতে গিয়ে চোটে পড়েছেন পগবা। যা ছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় ধাক্কা। দলটি প্রথম ধাক্কা খেয়েছে এনগোলো কান্তের ইনজুরিতে। চোট নিয়ে লম্বা সময়ের জন্য ছিটকে গেছেন তিনি। টুর্নামেন্টে শুরুর আগ মুহূর্তে আরও দুই ফুটবলারকে হারিয়েছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা। ইনজুরি কেড়ে নিয়েছে প্রেসনেল কিম্পেম্বে ও ক্রিস্টোফার এনকুঙ্কুর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন।
অ্যালেক্সিস সানচেজ (চিলি): ল্যাটিন আমেরিকান দল চিলি। গত বিশ্বকাপের মূলপর্বের টিকিট পায়নি তারা। কাতার বিশ্বকাপেও বাছাইপর্বের বাধা পাড়ি দিতে পারেনি তারা। ১০ দলের বাছাইপর্বে সপ্তম হয়েছে দেশটি। অথচ এই দলটিতে আছেন ক্লাব ফুটবল মাতানো বেশ কিছু ফুটবলার। অ্যালেক্সিস সানচেজ, ক্লদিও ব্রাভো, আর্তুরো ভিদালের মতো তারকাদের উপস্থিতির পরও বাছাইপর্বে বাদ পড়েছে চিলি। এবারের আসর মিস করবে তাদেরও।