বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, রশিদ খান, শেন ওয়ার্নরা যা পারেননি, তাই করে ফেলেছে আমাদের বরিশালের আসাদুজ্জামান সাদিদ। তাঁর এক ৪০ সেকেন্ডের ভিডিও শচীন টেন্ডুলকারের কল্যানে এখন বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয়ে গেছে।
ছয় বছর বয়সে কী করতেন?
এই ধরেন মাঠে একটু ছোটাছুটি, খেলনা নিয়ে কান্নাকাটি, ফুটবলে একটা লাথি বা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো। যাই করেন, সেই বয়সে নিশ্চয়ই আপনাকে বা আমাকে নিয়ে শচীন টেন্ডুলকার প্রশংসা করেননি!
আমার-আপনার মত সাধারণের কথা বাদ দিন। রশিদ খান বা ইমরান তাহির কী ছয় বছর বয়সে টেন্ডুলকারের নজর কাড়তে পেরেছিলেন? আরেকটু বড় করে বলা যাক। ছয় বছর বয়সী শেন ওয়ার্নের বোলিং কী টেন্ডুলকারকে মুগ্ধ করতে পারত?
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, রশিদ খান, শেন ওয়ার্নরা যা পারেননি, তাই করে ফেলেছে আমাদের বরিশালের আসাদুজ্জামান সাদিদ। তার এক ৪০ সেকেন্ডের ভিডিও শচীন টেন্ডুলকারের কল্যানে এখন বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয়ে গেছে।
টেন্ডুলকার নিজে সেই ভিডিও শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, ‘ওয়াও, এক বন্ধুর মাধ্যমে ভিডিওটি পেয়েছি- সত্যি অসাধারণ। ক্রিকেটের জন্য এই ছোট্ট শিশুর ভালোবাসা বোঝা যায়।’
এর নিচে বর্তমানের স্পিন সেনশেন রশিদ খান মন্তব্য করেছেন – স্কিল! মন্তব্যের পাশে আগুনের ইমোটিকন। এর আগে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক তারকা ও বর্তমান বিসিবি কর্মকর্তা শাহরিয়ার নাফিসও সাদিদের ভিডিও শেয়ার করেছেন।
বোঝাই যাচ্ছে, সাদিদের কীর্তিতে মুগ্ধ পণ্ডিতেরা। কিন্তু করেছে সাদিদ?
চল্লিশ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে সাদিদ আটটি বল করেছে। রিস্ট অ্যাকশন বলে দিচ্ছে, সে একজন লেগস্পিনার। কিন্তু মূল আকর্ষণের ব্যাপার হলো, সে ঠিক একই রিস্ট পজিশনে আট বলের মধ্যে ৩টি গুগলি করেছে। এই ৮ বলে সামনে উইকেট ও একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন। পাঁচবারই ব্যাটসম্যানরা বোল্ড হয়েছেন। একবারও কেউ বলে ব্যাট ছোয়াতে পারেননি।
তার কীর্তিটা বোঝাতে গিয়ে শাহরিয়ার নাফিস বলছিলেন, ‘এই বয়সে এতো চমৎকার রিস্ট পজিশন এবং টার্ন যথেষ্ঠ বিস্ময়কর। পাশাপাশি মূল যেটা সবাইকে অবাক করেছে, সেটা হলো একই অ্যাকশনে তার দুর্দান্ত গুগলি করতে পারাটা। এটা খুব বড় বড় বোলারদের জন্যেও স্বপ্নের একটা ব্যাপার। আর মনে রাখবেন, সাদিদের কোনো প্রথমগত ট্রেনিং নেই।’
হ্যাঁ, এটাই সাদিদের গল্প। সেই গল্পটা শোনা যাক।
সাদিদ মামা বাড়িতে বড় হচ্ছে। বরিশালের সদর থানার মহাবাজ গ্রামে তার মামার বাড়ি। এখানে তার অভিভাবক, শিক্ষক, বন্ধু; সবই হলেন মামা সিরাজুল ইসলাম শুভ। শুভ নিজে একসময় বিভাগীয় ক্রিকেট খেলেছেন। ব্যাটসম্যান ছিলেন। মামাকে দেখে সাদিদ তাই ব্যাটসম্যান হওয়া শুরু করলো।
গল্পটা শুরু হলো একটি বাংলাদেশের খেলা দেখার সময়। শুভ বলছিলেন, ‘সেই ম্যাচে সাকিব আল হাসান ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। সাদিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, মামা সাকিব আঙ্কেল পুরষ্কার পেলো কেন? আমি বললাম, সাকিব ব্যাটিং-বোলিং দুটোই ভালো করে। ও বললো, সেও বোলিং শিখবে। আমি অফস্পিনটা পারতাম। সেটা দেখানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও দেখি কবজি ঘুরিয়ে বল করছে। বুঝলাম লেগস্পিনার হতে পারবে।’
বাকিটা আসলে স্বপ্নের মত একটা ব্যাপার।
শুভ ক্রিকেটার হলেও নিজে লেগস্পিনার নন। ফলে তার পক্ষে সাদিদকে লেগস্পিনের খুটিনাটি শেখানো সম্ভব হচ্ছিলো না। কিন্তু সাদিদ যেনো কোনো এক অদৃশ্যের কাছ থেকে একা একা এই টার্ন, গুগলি শিখে ফেলছিলেন।
সাদিদের বোলিং যে ভালো হচ্ছে, সেটা অন্তত শুভ বুঝতে পারছিলেন। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভাগনের বোলিংয়ের একটা ভিডিও পোস্ট করলেন নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে। সেটা খুব ভাইরাল না হলেও চোখে পড়লো শাহরিয়ার নাফিসের। নাফিস সেই ভিডিও শেয়ার দেয়ার পাশাপাশি পুরো একটা দিন ভিডিওতে সাদিদের সাথে ক্লাশ করলেন।
নাফিস বলছিলেন, ‘খুব কুইক লার্নার সে। অনেক কথা সহজে ধরে ফেলতে পারে। ওর সাথে একদিন কাজ করার অভিজ্ঞতাটা খুব ভালো ছিলো। এখন তাকে নিয়ে যে একটা হইচই হচ্ছে, এটা দেখেও ভালো লাগছে।’
আর এর পরের ভিডিওটা তো খোদ টেন্ডুলকার শেয়ার করলেন। টেন্ডুলকারের শেয়ারের সেই খবর সাদিদ শুনেছে। টেন্ডুলকার কে, সেটা হয়তো সে ঠিক বোঝে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে, তাকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বোলিং ছেড়ে উঠে এসে আধো বোলে বললো, ‘আমার খুব ভালো লাগছে।’
এখন প্রশ্ন হলো, এখন সাদিদের ভবিষ্যত কি? তাকে নিয়ে কী বিসিবি কোনো পরিকল্পনা করবে? তাকে কি আমরা জাতীয় দলে দেখতে পাবো?
শাহরিয়ার নাফিস ও শুভ একবাক্যে ‘রে রে’ করে উঠলেন। দু জনই বললেন, এখনই এই ছেলেটিকে নিয়ে এসব চিন্তা করা বা বলা তার জন্য ক্ষতিকর। নাফিস বলছিলেন, ‘আধুনিক কোচিং পদ্ধতি বলে, ১২-১৩ বছরের আগে প্রাতিষ্ঠানিক কোচিংয়ের কোনো দরকার নেই। ওকে এখন মনের আনন্দে খেলতে দিতে হবে। কেউ একটু গ্রিপ ঠিক করে দিলো, কেউ একদিন ট্রেনিং করালো; এটাই যথেষ্ঠ। এই পর্যায়ে ওকে ট্রেনিং চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি ওর মামাকে বলেছি, জাস্ট ওকে খেলাটা এনজয় করতে দেন। নিজের মত বোলিং করুক, মনের আনন্দে বল পেটাক।’
এই জায়গাটায় নাফিসের সাথে খুব একমত শুভ। তিনি এই হাইপে ভেসে যাচ্ছেন না। তাদের স্বাভাবিক একটা পরিকল্পনা আছে। বলছিলেন, ‘যে যাই বলুক, আমরা ওকে এখনই কিছু চাপিয়ে দেবো না। অন্তত ক্লাব ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত আমি যেভাবে পারি, দেখে রাখবো। নিজের মনে খেলবে। এরপর বিকেএসপিতে ভর্তির চেষ্টা করবো। ওকে কোনো প্রত্যাশার চাপ দিতে আমরা রাজী নই।’
তবে সাদিদের নিজের মধ্যে একটা ‘ছোট্ট’ প্রত্যাশা আছে। তাঁর প্রিয় ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি, প্রিয় বোলার রশিদ খান। কিন্তু সে কী হতে চায়? সে চায় সাকিব আল হাসান হতে। সে একবার সাকিবকে দেখতে চায়।
সেই আলতো কণ্ঠেই বললো, ‘আমি ভালো বোলিং করলে সাকিব আঙ্কেলকে দেখতে পাবো না? আমি ওনার মত হতে চাই।’
গর্ব এটাই যে, আমাদের এখন নিজস্ব আইডল আছে।