চলতি শতাব্দিতে বাংলাদেশ দলে অভিষিক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সম্ভাবনাময় তরুণ তারকা। এদের মধ্যে কয়েকজন নিজেদেরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেও, অনেকের কপালে সেই সৌভাগ্যটা ছিল না
একসময়ের হার্ড হিটার এবং মিস্টার ফিনিশার সাব্বির রহমান তাদেরই একজন। ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র ২৫ বলে অপরাজিত ৪৪ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পথচলা শুরু করেন সাব্বির রহমান রুম্মান।





এরপর থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে টাইগারদের হয়ে ফিনিশিংয়ের দায়িত্বভারটা তার কাঁধে গিয়েই বর্তায়। অন্যদিকে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সোনালি অধ্যায়ের শুরুটাও হয় সেখান থেকেই।
কিন্তু কেন পরবর্তিতে সেই সাব্বিরই ফর্ম হারিয়ে আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট (খ্যাপ) খেলে চলেছেন? এর সম্ভাব্য তিনটি কারণ চলুন দেখে নেওয়া যাক।





বিসিবির অদূরদর্শিতা
এটি একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ যে, বিশ্বের শীর্ষ ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো এখনও অনেকটা দুর্বল।
যে কারণে ক্রিকেট বোর্ডের হাতেও বিকল্প খেলোয়াড়ের সংখ্যা খুবই কম থাকে। ফলে কেউ যদি দুয়েকটা সিরিজে ভালো খেলে ফেলে, তখন তার ওপর অন্ধের মতো ভরসা করতে থাকেন নির্বাচকরা।





এরপর টানা কয়েকটি ম্যাচে বাজে পারফর্ম করলেও, সেই ক্রিকেটারকে দল থেকে বাদ দিয়ে নিবিড় পরিচর্যা করার ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করতে হয় তাদের।
আবার কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে, কোনো ক্রিকেটার যদি একটি বা দুইটি ফর্ম্যাটে ভালো খেলে, তাহলে তাকে জোর করে সব ফর্ম্যাটে খেলিয়ে তার স্বকীয়তা নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।
সাব্বিরও যে এই তালিকা থেকে বাদ যাননি, সেটা ছোট্ট একটি উদাহরণেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপে যখন তিনে খেলতে নেমে তিনি কোহলি-শর্মাদের টপকে টুর্নামেন্টের শীর্ষ রান সংগ্রাহকের পাশাপাশি টুর্নামেন্ট সেরা বনে যান, তখন বিসিবির মাথায় পোকা ঢুকে যায় যে, তাকে এখন সব ফর্ম্যাটেই টপ অর্ডারে খেলাতে হবে।
এরপর তিনি সেখানে কখনো সফল হয়েছেন, আবার কখনো ব্যর্থ। এমনকি একবার একটি টেস্ট সিরিজে সাব্বিরকে খেলানোর কারণ হিসেবে বিসিবি কর্তারা জানান, আসন্ন টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রস্তুতি হিসেবেই তাকে টেস্ট খেলানো হচ্ছে! এভাবে তিলে তিলে অধঃপতিত হতে হতে আজ জাতীয় দলের সম্ভাব্য স্কোয়াড থেকেও বাইরে চলে গেছেন তিনি।





স্থানীয় কোচদের ব্যর্থতা
ক্রিকেট বিশ্বে পরাশক্তির দেশগুলোয় ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো যেমন শক্তিশালী, তেমনি সেখানকার স্থানীয় কোচরাও অত্যন্ত দায়িত্বপরায়ণ হয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে যার অভাব শুরু থেকেই রয়েছে। কেউ ভালো না খেললে, স্থানীয় কোচরাও তাদেরকে সময় দিতে চান না বলেই পরবর্তীতে সেই ক্রিকেটারকে আরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
এব্যাপারে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির বাংলা বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশি ক্রিকেট বিশ্লেষক এম এম কায়সার বলেন, ‘যাদের মনে করা হয় ভবিষ্যৎ আইকনিক ক্রিকেটার, তাদের ধরে রাখার জন্য, খেয়াল রাখার জন্যই কোচ রাখা হয়। তাহলে আর পাড়ার ক্রিকেটে খেলতে হয় না সাব্বিরদের।’
এছাড়া নাসির হোসেনের উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, কোচদের এরকম কর্তব্যহীনতার জন্যেই দেশের অনেক সম্ভাবনাময় ক্রিকেটাররা অকালে হারিয়ে গেছেন।
এরপর প্রতিবেশি দেশের স্থানীয় কোচদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে জনাব কায়সার বলেন, ‘আপনি দেখেন অস্ট্রেলিয়ায় ব্যর্থ হওয়ার পর, (ভারতে) স্থানীয় কোচরা (পৃথবি) শ’কে নিয়ে ডায়গনসাইস করেছে, তাকে তার সমস্যা দেখিয়ে দিয়েছে। এখন ঘরোয়া ক্রিকেটে কিন্তু শ তার আসল রূপ ফিরে পেয়েছেন।’
এছাড়া সাব্বিরের মতো ক্রিকেটারদের প্রয়োজন নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করা, ক্রিকেটের প্রতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখা, যেটা বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রিকেটারের নেই বলে মনে করেন তিনি।
অহংকার এবং বাজে আচরণ
কথায় আছে, ‘অহংকার পতনের মূল’ এবং ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’। সাব্বিরের ক্ষেত্রেও এই প্রবাদগুলো ষোলো আনা খেটেছে।
২০১৪ সালে দারুণভাবে অভিষিক্ত হবার পর থেকে তিনি এতোটাই অহংবোধে মত্ত হয়েছিলেন যে, ২০১৪-১৭ টানা তিন মৌসুমে কোনো প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্টে খেলেননি।
এমনকি গণমাধ্যমের সামনেও দাম্ভিকতা প্রকাশ করে সেসময় যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। হয়তো, সাফল্যের রাজ্যে প্রবেশ করে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন যে, সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কারো মাঝে এই গুণটি শোভা পায় না।
অহংকারের পাশাপাশি সেসময় সাব্বিরের নৈতিক আচরণেও চরম স্খলন ঘটে। কখনো খেলার মাঝে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ইট ছুঁড়ে মেরেছেন, তো কখনো গ্যালারিতে গিয়ে দর্শক পিটিয়েছেন।
তার এই দুর্ব্যবহার থেকে বাদ যাননি ব্যক্তিগত ড্রাইভারও। এছাড়াও একবার নারী কেলেঙ্কারিতে পর্যন্ত নাম লিখিয়েছিলেন তিনি।
এভাবে একের পর এক অভিযোগ আসা শুরু হলে তার নাম বদলে গিয়ে হয় ‘ব্যাড বয়’। এভাবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে ক্রিকেটের রঙিন জগত থেকে ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে গেছেন তিনি।





তবে জাতীয় দলে খেলে যাওয়ার আশা এখনো হারাননি সাব্বির। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘এখন খেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি খেলে যাবো, খেলার চেষ্টা করবো। যদি নজরে আসি, নির্বাচকরা মনে করেন, আমি পারবো, আমি খেলবো।’